পর্বত অভিযানে পাঁচ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী.....
পাঁচজন অভিযাত্রী। প্রত্যেকের চোখেই সমস্যা। কেউ পুরোপুরি দৃষ্টিহীন, আবার কেউ আংশিক দেখতে পান। কিন্তু এই বড় প্রতিন্ধকতাকে জয় করেই তাঁরা গত সপ্তাহে ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলীয় একটি পার্বত্য এলাকা হেঁটে অতিক্রম করেছেন। এ অভিযানে তাঁদের সহায়ক ছিল দিক ও অবস্থান নির্ণয়ের জন্য জিপিএসনির্ভর বিশেষ একটি প্রযুক্তি। এটি বিশ্বজুড়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী লাখো মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস হচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের তথ্যের মাধ্যমে দিক ও অবস্থান নির্ণয়ব্যবস্থা। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে সামরিক-বেসামরিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়।
অভিযাত্রীদের সঙ্গে ছিল সাদাছড়ি ও স্মার্টফোনের একটি অ্যাপ। অ্যাপটি ব্যবহারের জন্য স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন কারও সহায়তা নেওয়া হয়নি। জার্মানির সীমান্তের কাছে অভিযাত্রীরা ছয় দিনে ভজ পার্বত্য এলাকার ৮০ কিলোমিটার পার হন। তাঁরা শরীরে একটি ছোট থলের মতো জিনিস জড়িয়ে নেন, যার নাম নেভির্যা ন্ডো। যন্ত্রটিই নিয়মিত বিরতিতে সতর্ক করে দেয়, সামনে কোনো মোড় আছে কি না এবং কোথায় পথ বদলাতে হবে ইত্যাদি। যেমন নেভির্যা ন্ডের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর কখনো বলে ওঠে, ‘পয়েন্ট ১৫, বেলা ১১টা, ১৯৪ মিটার’। এর মানে হলো আর মাত্র ২০০ মিটারের কম এগোলেই ‘বেলা ১১টার’ নির্দেশনা অনুযায়ী বাঁ দিকে মোড় নিতে হবে।
নেভির্যা ন্ডো তৈরি করেছেন ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় স্ত্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের লক্ষ্য, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জীবনযাপনের ধরন উন্নয়ন। অভিযান শুরুর আগে তাঁদের জন্য ফ্রেঞ্চ হাইকিং ফেডারেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা একটি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের আয়োজন করেন এবং শিখিয়ে দেন কীভাবে পাহাড়ি পথে চলার সময় বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে হয়। অভিযাত্রী জ্যঁ-ক্লদ ইম জন্ম থেকে দেখতে পান না। তিনি বলেন, পাহাড়ি পথে কেবল ছড়ি ব্যবহার করে পথচলা কঠিন। গভীর মনোযোগ রাখতে হয়—ঘ্রাণ, স্পর্শের অনুভূতি, বৃষ্টি এবং পাখির কলতানের বিষয়ে।
৬৩ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষক ইম নিয়মিত পাহাড়-পর্বতে যান। তবে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন কোনো সঙ্গী ছাড়া এবারই প্রথম তিনি ভজ এলাকায় গেলেন। আরেক অন্ধ অভিযাত্রী নিকোলা লিন্দে। বয়স ৩০ বছর। তিনি বলেন, নতুন যন্ত্রটি (নেভির্যা ন্ডো) আত্মবিশ্বাস এবং স্বনির্ভরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি ব্যবহার করলে নিজের স্বাধীনতাকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। চোখে সমস্যা আছে এ রকম ৯৫ শতাংশ মানুষেরই বাড়ির বাইরে যেতে সমস্যা হয়।
নেভির্যা ন্ডো প্রযুক্তি যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের জন্য ওই দৃষ্টিহীন ব্যক্তিদের অভিযানটি একটি বড় পরীক্ষা ছিল। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য জিপিএস প্রযুক্তি আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে স্ত্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিদ্যা বিভাগের গবেষক লরোসঁ্ রাসনর বলেন, এই প্রথম জিপিএস সংকেতকে আরও সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর করতে এবং পুরো যাত্রার সময় ঠিকভাবে হিসাব করতে আইএমইউ ব্যবহার করা হয়েছে।
আইএমইউ হচ্ছে দিক নির্ণয়ের জন্য জাইরোস্কোপ, ব্যারোমিটার ও একসেলোমিটারের সমন্বিত কাজের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র। উড়োজাহাজ বা মানুষবিহীন উড়ন্ত যানেও এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন জেসুস জেগারা। তিনি বলেন, আইএমইউ যেকোনো স্থানে ঠিকমতো কাজে লাগানোর বিষয়টি নিশ্চিত করাই তাঁদের পরবর্তী লক্ষ্য। এমনকি যে জায়গা থেকে জিপিএস সংকেতও ঠিকমতো পাওয়া যায় না, সেখানেও এ প্রযুক্তি ব্যবহারে সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। এমনও হতে পারে, একদিন দৃষ্টিহীন মানুষেরা এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কোনো পাতালপথের সিঁড়ি দিয়ে কারও সাহায্য ছাড়াই ওঠা-নামা করতে পারবে।
সূত্র: এএফপি।