ভয়ংকর সুন্দর আর্জেন্টিনা!
অর্কেস্ট্রার সব যন্ত্র একই সঙ্গে ঝংকার তুললে কেমন শোনায়? বাগানের সব ফুল যদি একসঙ্গে ফোটে? কাল কনসেপসিয়নে সব ফুলই যেন সৌরভ ছড়াল। এত দিন বেসুরো বাজতে থাকা সংগীত মিলল ঐকতানে। আর সেই মদির-গন্ধ আর সুরে যেন প্যারাগুয়ে সম্মোহিত হয়ে পড়ল। প্যারাগুয়েকে সেমিফাইনালে ৬-১-এ হারিয়ে আর্জেন্টিনা উঠে গেছে কোপা আমেরিকার ফাইনালে। ২২ বছর পর প্রথম বড় কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ের খুব কাছাকাছি এখন আকাশি-নীল ফুটবল দল—আলবিসেলেস্তে।
একঘেয়ে, বিরক্তিকর ফুটবলের একটা বিজ্ঞাপনই যেন হয়ে উঠছিল এবারের কোপা। গোল-খরা, মনে রাখার মতো গোল নেই, দুর্দান্ত কোনো বিল্ড-আপ নেই—খেলা দেখার উত্তেজনা মিইয়ে গিয়েছিল অনেকটাই। কাল সেই আক্ষেপ ঘুচল একসঙ্গে। কালকের আগ পর্যন্ত যে আর্জেন্টিনা চার ম্যাচে করেছিল মাত্র চার গোল, সেই তারাই প্যারাগুয়ের সঙ্গে ৫৩ মিনিটে করে ফেলল চার গোল! সাত গোলের ম্যাচে অনেক মুহূর্তই ঘুম ঘুম চোখে এনে দিয়েছে রোমাঞ্চের আবেশ।
কোনটা ছেড়ে আসলে কোন মুহূর্তের কথা বলা যায়? ২৭ মিনিটে মেসির দুর্দান্ত রক্ষণচেরা পাসটা হাভিয়ের পাস্তোরে যেভাবে ধরলেন সেটা? পরে পাস্তোরেরই বুটের আলতো ছোঁয়ায় ডি মারিয়াকে দেওয়া পাসটা? নাকি প্যারাগুয়ের দুই ডিফেন্ডারকে ঘোল খাইয়ে ডি মারিয়ার জন্য মেসি যে গোলটি বানিয়ে দিয়েছেন সেটি? ‘ফুটবল তার সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে হাজির’—অতিব্যবহৃত কথাটা কী সুন্দরভাবেই না রূপায়িত হলো আর্জেন্টিনার খেলায়।
কয়েক দিন থেকে প্রশ্নটা গুঞ্জরিত হচ্ছিল, যে দলে মেসি, আগুয়েরো, হিগুয়েইনদের মতো ফরোয়ার্ড আছেন, সেই দল গোল পাচ্ছে না কেন? ডি মারিয়া, পাস্তোরেরা সেভাবে মেলে ধরতে পারছেন না কেন? এই ম্যাচটা সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে দিয়েছে। আগুয়েরো-হিগুয়েইনদের গোলই বেশি স্বস্তি দেবে মার্টিনোকে। আর্জেন্টিনার হয়ে দুজন ৫৩ গোল করেছেন, কিন্তু একই ম্যাচে তাঁদের গোল করার ঘটনা এটি দ্বিতীয়। ২০১০ সালে প্রীতি ম্যাচে স্পেনের সঙ্গে ৪-০ গোলের জয়ে দুজনেই স্কোরলাইনে নাম লিখিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে গোল পেয়েছিলেন মেসিও।
পরশু সেই ত্র্যহস্পর্শ আসতে আসতেও আসেনি। শেষ পর্যন্ত মেসি গোল পাননি, তবে সেটা নিয়ে কোচ জেরার্ডো মার্টিনো একদমই উদ্বিগ্ন নন। ম্যাচটা তো আসলে ছিল মেসিময়। ১৯৯৭ সালের পর কোপার সেমিফাইনালে সবচেয়ে বড় জয়, প্যারাগুয়ের সঙ্গে ১৯৪৭ সালের পর সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়—মেসি না থাকলে হয়তো এসবের কিছুই হতো না।
শুরুটাই ছিল মেসিকে দিয়ে। ১৫ মিনিটে মার্কোস রোহো গোল করে এগিয়ে দেন মেসির ফ্রিকিক থেকে। ২৭ মিনিটে পাস্তোরের গোল, এবারও কারিগর মেসি। এরপর লুকাস ব্যারিয়সের গোলে একটু ফেরার চেষ্টা করেছিল প্যারাগুয়ে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ৮ মিনিটে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার জোড়া গোল ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় প্যারাগুয়েকে। পরে আগুয়েরো-হিগুয়েইনের গোলে উৎসবটা আরও আনন্দময় হয়েছে আর্জেন্টিনার।
আর্জেন্টিনা কোচ এরপরও ঠিক সন্তুষ্ট নন, ‘কলম্বিয়ার সঙ্গে আমাদের খেলাটা বেশি ভালো ছিল। কিন্তু বল কেড়ে নেওয়ার বেলায় আমরা ওই ম্যাচের চেয়ে অনেক ভালো খেলেছি। আমরা সেভাবে প্লেসিং করতে পারিনি, নিজেদের অর্ধে তো বটেই, ওদের অর্ধেও। আমি ৬-১ গোলের স্কোরলাইন নিয়ে খুশি, কিন্তু ফাইনালের আগে যদি কিছু ঠিক করতে হয় তাহলে অবশ্যই করব।’
শুধু মার্টিনোই করবেন কেন, আকাশি-নীল জার্সি গায়ে অতৃপ্তি ঘোচাতে মেসিরাও কিছু করবেন! ৪ জুলাই ফাইনালের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক চিলিও সেটি ভালো করে জানে।
এএফপি।